আবদুল হক সরকার,হোমনা
কুমিল্লার হোমনা উপজেলার সংস্কৃতির সভ্যতার ঐহিত্যবাহী নিদর্শন শ্রীমুদ্দি গ্রামের বাঁশের বাঁশি তৈরির ইতিহাস। এখানকার তৈরি বাঁশিতে সুর তুলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সুরকাররা। এশিয়া, ইউরোপ ও আমেরিকাসহ অন্তত ২৫টি দেশে খ্যাতি রয়েছে শ্রীমদ্দি গ্রামের বাঁশের বাঁশির। বৈশাখ ঘিরে ব্যস্ততা বেড়েছে এ গ্রামের বাঁশিওয়ালাদের।
বাঁশি তৈরীর ইতিহাস:
কথিত আছে এক শ থেকে সোয়া শ বছর আগে ভারত থেকে কোকিল দাস বৈরাগী এবং দীনবন্ধু বৈরাখী শ্রীমদ্দি গ্রামে এসে চিকন মুলি বাঁশ দিয়ে বাঁশি তৈরি শুরু করেন। নিজেরা বাঁশি বাজাতেও পারতেন। তাই তাঁরা ফেরি করে বিক্রি বাঁশি বিক্রি করতেন। বিশেষ করে বৈশাখ মাস এলেবাঁশি তৈরী করে বিভিন্ন মেলায় তারা এ বাশিঁ বিক্রি করতেন।
মুলির বাঁশি সাধারণত ১৩ থেকে ২০ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয়। প্রতিটি বাঁশিতে তিন থেকে সাতটি ছিদ্র থাকে। শ্রীমদ্দি গ্রামের হিন্দু মুসলিম প্রায় ৫০টির বেশি পরিবার পূর্ব পুরুষের ঐতিহ্য লালন করে বাঁশের বাঁশি বানিয়ে কোনো মতে জীবিকা নির্বাহ করছে। পরবর্তীতে ৭০ দশকের দিকে নবীন দাস ও কুলিন দাস নামে দুই বৈরাগী ভ্রাতা বানিজ্যিক ভাবে বাঁশি বানানোর কাজ শুরু করেন। বাংলাদেশের আর কোথাও বাঁশি তৈরির এমন পুরোনো ঐতিহ্য খুঁজে পাওয়া যায় না।
বাঁশি তৈরীর পদ্ধতি :
একটি বাঁশি তৈরি করতে ১৩-১৪টি ধাপে কাজ করতে হয়। প্রথমে মুলি কেটে শুকাতে হয়। পরে মুলি চেছে ফেলে স্কেলের মাধ্যমে ছিদ্র করা হয়। প্রতিটিতে ছিদ্র করার জন্য স্কেলের মাধ্যমে পেনসিল দিয়ে দাগ কাটা হয়।তবে আড় বাঁশির ক্ষেত্রে কাদামাটি দিয়ে বিভিন্ন নকশা তৈরি করে আগুন দিয়ে সেঁক দিয়ে মুলির গা থেকে মাটি শুকিয়ে পড়ে গেলে নকশা ফুটে ওঠে। চোখা শিক গরম করে ছিদ্র করা হয়। সে কাজে কয়লা ব্যবহার করা হয়। মুখ ও তোতা বাঁশির ক্ষেত্রে মুলি কাটার পরে মান্দাল কাঠ দিয়ে কটি বানিয়ে বাঁশির ভিতরে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।পরে শিরিষ কাগজ দিয়ে ঘষে মসৃন করতে হয়। এরপর ধোয়ার কাজ শেষ করে বিভিন্ন রং দিয়ে নকশা করা হয়। পরে প্যাকেট করে বাজারজাত করা হয়। বাঁশি পল্লীতে ৯ রকমের বাঁশি তৈরী হয় এর মধ্যে আছে পাখি বাঁশি, ভীন বাঁশি, মোহন বাঁশি, নাগিনী বাঁশি, ক্যালেনের বাঁশি, মুখ বাঁশি, মোহন বাঁশি বড়, আড় বাঁশি, বেলুন বাঁশি, ফেন্সি বাঁশি, হুইসেল বাঁশি ও চাবি রিং বাঁশি ইত্যাদি।
বাঁশির ক্রেতা কারাঃ
দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ক্রেতারা বাঁশি কিনতে এই গ্রামে ভিড় জমায়। বৈশাখী মেলাকে কেন্দ্র করে চৈত্র মাস থেকে ক্রেতার ভিড় বেশি হয়। বিভিন্ন জেলা, উপজেলা থেকে বাঁশি কিনতে আসে। নবীনগর উপজেলার নজরুল ইসলাম নামের এক ক্রেতা (পাইকার) বলেন, অনেক বছর ধরে শ্রীমদ্দি থেকে বাঁশি কিন্না নিয়া বিক্রি করতাছি। আমি দেখেছি যুবকরাই বাঁশির মূলত ক্রেতা, তবে শিশুদের চাহিদাও কম নয়। এমনও দিন গেছে কোন কোন মেলায় এক হাজার বাঁশি বিক্রি করা যাইত।বর্তমানে ডিজিটাল সাউন্ড সিস্টেস, প্লাস্টিকের খেলনা এবং মোবাইলের দিকে যুবক ও শিশুদের আগ্রহ বাড়ারর কারনে বাঁশি বিক্রি কমে গেছে। তবে এ ঐতিহ্যবাহী মুলির বাঁশি হোমনার মিরাশের মেলা, শ্রীমদ্দি কালি বাড়ির মেলা, কচুয়ার সাচারের রথ মেলা, ধামরায়ের রথমেলা, মতলবের বেলতুলীর লেংটার মেলা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া খরমপুরের মেলা, চট্টগ্রামের জব্বারের বলী খেলা, নাঙ্গলবন্দের অষ্টমী স্নান, সাতক্ষীরার পূজার মেলা, কুষ্টিয়ার, গাজীপুরে মৌসুমী বাঁশি বিক্রি ছাড়াও প্রায় সাড়া বছরই দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, শহর, বন্দর, হাট-বাজারে তারা তাদের বাঁশিবিক্রয় করে থাকে।
বাঁশি রপ্তানিতে বৈদেশী মুদ্রা আয়:
এ ছাড়া এক শ্রেণির ব্যবসায়ি( পাইকার) শ্রীমদ্দি গ্রাম থেকে বাঁশি কিনে পাঠাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কুয়েত,সংযুক্ত আরব আমিরাত ,বাহরাইন, ওমান,কাতার, মালয়েশিয়া, ইউরোপের ইতালি ,জার্মানি, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন, নেদারল্যান্ড ,কানাডা , এশিয়ার জাপান , থাইল্যান্ড , সিঙ্গাপুর, আমেরিকাসহ আরো অনেক দেশে। এতে জাতীয় অর্থনীতিতে যক্ত হচ্ছে অনেক বৈদেশী মুদ্রা।
বৃহস্পতিবার সরেজমিনে গিয়ে দেখাগেছে,
এই গ্রামের অন্তত হিন্দু মুসলিম ৫০টি পরিবার বাঁশি তৈরির কাজ করছে। এতে ৬০ বছরের বৃদ্ধ নারী-পুরুষ থেকে শুরু করে স্কুলগামী শিশুরা রয়েছে। বাঁশিতে নকশা তৈরি, ছিদ্র করা, ধোয়া-শুকানো এবং রং করার কাজ সাধারণত করেন নারীরা।
তাদের সুযোগ সুবিধা:
কথা হয় বাঁশি ওয়ালা নিরঞ্জন চন্দ্র সরকার অনিল চন্দ্র বিশ্বাস ও যতীন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাসের সাথে। তারা বলেন,’বাঁশির গুণগত মান বাড়িয়ে বিদেশে অধিক হারে রপ্তানি করা যাবে, যদি সরকারের সহযোগিতা পাওয়া যায়। যতীন্দ্র চন্দ্র বিশ্বাস অভিযোগ করেন, ‘চট্টগ্রাম থেকে বাঁশ এনে বাঁশি তৈরি করতে হয়। চট্টগ্রাম থেকে গৌরীপুর পর্যন্ত মহাসড়কে জায়গায় জায়গায় চাঁদা না দিয়ে বাঁশ আনা যায় না। বাঁশি শিল্পের সাথে যারা জড়িত তারা অনেকেই নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের অনেকের পুঁজির অভাব। দার দেনা করে, এনজিও থেকে কড়া সুদে টাকা এনে কাজ করতে হয়। স্বল্প সুদে ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা থাকলে এ শিল্পের আরো বিকাশ ঘটতে পারতো।
শ্রীমদ্দি গ্রামের জনপ্রতিনিধি হোমনা উপজেলার সাবেকউপজেলা চেয়ারম্যান এ্যাড. মো. আজিজুর রহমান মোল্লা বলেন,বাঁশি শিল্পের সাথে যারা জড়িত তারা অনেকেই নিম্ন আয়ের মানুষ। তাদের অনেকের পুঁজির অভাব কাজ করতে পারে ন। বৈশাখ আসলেই তাদের কদর বাড়ে। অন্য সময় তাদের খবর কেহ রাখে না। আমি চেয়ারম্যান থাকা কালীন সময় চেষ্ঠা করেছিলাম স্বল্প সুদে তাদের ঋণ দেয়া যায় কি না। কিন্ত তা সম্বব হয় নাই। তারা দার দেনা করে, এনজিও থেকে কড়া সুদে টাকা এনে কাজ করতে হয়।এ শিল্প টিকাতে হলে সরকারি ভাবে সহযোগীতা করা প্রয়োজন।
এ বিষয়ে হোমনা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) ক্ষেমালিকা চাকমা বলেন, দেশি ঐতিহ্য ধরে রাখতে শ্রীমদ্দির বাঁশি তৈরিতে উৎসাহ দেওয়া উচিত। তাদের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা কর যায় কিনা বিভিন্র ব্যাংকের সাথে কথা বলবো। এ ছাড়া এ শিল্পে সরকারি সহযোগিতার সুযোগ আছে কিনা পেলে ব্যবসার প্রসার ঘটানো যাবে, সে উদ্যোগ নেওয়া হবে।’